অমরনাথ মুখার্জী
আমার লেখার অভ্যাস নেই। তবু আমি মাঝে মধ্যে একটু আধটু লিখি। লিখি তার কারণ, একটি কর্তব্যবোধ। এই কর্তব্যবোধটি আমার মনকে মাঝে মাঝেই ভীষনভাবে তাড়া করে। মনে হয়, এ জীবনে কত বিচিত্র ভাবনা, অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি যা সারাজীবন মনের মনিকোঠায় সঞ্চয় করে রেখেছি, আমার এ দু-চোখ যখন শেষবারের মতো বন্ধ হয়ে যাবে তখন বহুমূল্যবান ঐ পার্থিব সঞ্চয়গুলি এক অচেতন জগতে আমারই সাথে বিলীন হয়ে যাবে। তাই যা কিছু সারাজীবন আহরন করে গেলাম যাবার বেলা সে তো আমাকে ফেরত দিতেই হবে। আমাদের আগামী প্রজন্ম ঐ ছোটো ছোটো ভাবনা, উপলব্ধি, অনুভূতি থেকে হয়তো বা তারা আরো অনেক বড়ো ভাবনার, উপলব্ধির ইঙ্গিত পেতে পারে। ভাবনাই তো ভাবনার জননী।
আমার দাদু শুনেছি খুব জ্ঞানী-গুণী- পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। দেড়শ বছরের পুরানো তাঁর একটি ছবি আমার কাছে আছে। মাঝে মাঝে সেটিকে আমি দেখি। সেসময় একটি চিন্তা আমাকে আলোড়িত করে; আজ যদি ওঁনার কোনো লেখা পড়তে পারতাম, তাহলে ওঁনার দেখা সেই সময়কে, সমাজকে এবং ওঁনার পারিবারিক সম্পর্কগুলোকে উনি কিভাবে দেখতেন জানতে পারতাম। কি কি ধরণের উপলব্ধি, অনুভূতি, ভাবনা ওঁনার চিন্তার জগতকে আলোকিত করেছিল, এসব জানার আজ আর কোনো উপায় নেই। আমি নিশ্চিত তাঁর মতো মানুষের লেখা পড়তে পারলে আমি এ সবকিছুর একটা আভাস পেতাম। আমার চিন্তা, চেতনার মান ও পরিধির প্রসারে আরও সুযোগ অবশ্যই পেতাম।
তাই আমি আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই সংসার বা সমাজকে কিভাবে দেখলাম তার হিসাব নিকাশ কোথাও না কোথাও নথিবদ্ধ করে রাখতেই হবে। It has to be documented, disseminated & discussed so as to be able to enlighten each other.
মাঝে মাঝে আমার চেতনা আমাকে ভাবায়। কেন এ সংসারে আমি এসেছি ? জীবনের এই পথ চলার উদ্দেশ্য কি ? কোথায় এর শেষ গন্তব্যস্থল ? জীবনে কি পেলাম ? কেনই বা অনেককিছু পেলাম না ? না পাওয়ার হতাশা কি পাওয়ার আনন্দে মুছে ফেলতে পেরেছি ? জীবনান্তে কি রেখে যাবো ?
আমার আজীবনের কুড়ানো ঐ পার্থিব ভাবনা উপলব্ধির মনিমানিক্যগুলি ভাবী প্রজন্মের প্রাণের মিছিলে জোনাকির মতো হয়তোবা কোথাও কোথাও আলোর ইঙ্গিত দেবে। তাই স্থির করেছি এসব আমি লিখব। আমার কর্তব্যবোধেই আমি লিখব।
দিনের অবসরে যখন প্রকৃতির কাছে নিবিড়ে নীরবে মুখোমুখি হবার সুযোগ পাই তখন দেখতে থাকি আমি এক চেতনাদীপ্ত প্রানী। চারিপাশে গাছপালা, পশুপাখি সবাই তাদের সজীবতা নিয়ে আমায় ঘিরে আছে । আবার ঐ অচেতন বস্তুগুলিও — যেমন ঐ মাটি, পাথর, মরে যাওয়া শুকনো গাছ, অনর্গল বয়ে যাওয়া ঝরণার জল সবই ঐ সচেতন অচেতনের সহাবস্থান। দেখতে দেখতে মনটাকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করে দেয়। মনে হয় ঐ যে বড়ো গাছটি জীবিত অবস্থায় ফুলে ফলে ভরে উঠে কত না হাওয়ার সাথে দোল খেয়ে, আলো আঁধারে লুকোচুরি খেলছে। কিন্তু আজ আর সে নেই ; নেই বলবো না , সে আছে এক অচেতন জগতে। তার অতীত সজীবতার সাক্ষর নিয়ে, আমার সামনে দাঁড়িয়ে। যতদিন না অন্য কোনো সজীব বস্তু তার এই অবস্থার পরিবর্তন করছে , শুকনো গাছ ততদিন ধরে জীবনের শেষ স্বাক্ষর নিয়ে ঐভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে। পশু পাখি গাছপালার মতো আমিও আজ সজীব। মহাকালের অমোঘ নিয়মে আমিও একদিন অচেতন বস্তুতে বিলীন হয়ে যাবো।
অচেতন আর সচেতনতার প্রভেদ কোথায় ? সচেতন বস্তুর মধ্যে প্রাণের স্পন্দন আছে। অচেতন বস্তু প্রাণহীন। সচেতন বস্তুর প্রজনন প্রবৃত্তি বিদ্যমান। অচেতনের এ প্রবৃত্তি অবর্তমান। সচল এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ সক্রিয়তাই সজীবের প্রাণের ইঙ্গিত। শুধু সচলতাই অচেতনের প্রাণের প্রকাশ নয় (গাড়ি, ফ্যান সবই চলে, তারা অচেতন বস্তু)। দুই অচেতন বস্তুর বিশেষ এক পরিবেশে ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলস্বরূপ আকস্মিকভাবে বস্তুর সচেতনতা প্রাপ্তি। নারী ও পুরুষের যেমন কেশ উদগম হয় বাইরের শীত,উষ্ণ, রৌদ্রকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য, হাত-পায়ের নখ আত্মরক্ষার জন্য। তেমনি মাতৃস্তন্যে দুধ আসে নবজাতকের জীবন ধারণের জন্য, শুক্রানু বা ডিম্বানুর উৎপাদন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। এ সবই কিন্তু এক সজীব প্রাণী থেকে উৎপাদিত নির্জীব বস্তু; এক অচেতন পদার্থ। প্রাণী জগতের উৎপত্তি ঐ অচেতন জগৎ থেকেই। আবার সেই প্রাণের বিলয় ঐ অচেতনের মধ্যেই।
মানবজীবনের উদ্দেশ্য কি ? কোন উদ্দেশ্যে জীবন ধারণ করা ? উত্তরে বলা যায় একটি উদ্দেশ্য নিয়ে জীবিত থাকা এবং সেই উদ্দেশ্যটি হল, সে যেন আজীবন তার পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য কিছু না কিছু কর্মে ব্যাপৃত হয়ে থাকা। নতুবা সে পরিবার বা সমাজ থেকে অবাঞ্ছিত হতে বাধ্য ; পরিনামে যে আবেগপূর্ণ মানসিক বন্ধন নিয়ে মানুষ তার পরিবারের সাথে, সমাজের সাথে জুড়ে আছে, সে বন্ধনটি ছিঁড়ে যাবে।
তারই সর্বপ্রথম প্রস্তুতি, নিজের কিছু করার মতো সামর্থ অর্জন করে রাখা। মানসিক এবং শারিরীকভাবে। মানসিক ও শারিরীকভাবে সমর্থ থাকার একমাত্র উপায় আমাদের খাওয়া দাওয়া ও জীবনশৈলী (স্বাস্থ্যচর্চা)। খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রু আমাদের স্বাদবোধ। যেটি চারপ্রকারে আমাদের সাথে শত্রুতা করে। স্বাদ চায় মুখোরোচক খাদ্য, যারফলে জাঙ্ক ফুড আমাদের বেশী ভালো লাগে, শরীরে পৌষ্টিক খাদ্য মুখোরোচক হলে তো আর কথাই নেই, দেহের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য আমরা গ্রহন করে ফেলি। শত্রুতার তৃতীয় ধরনটি হল আমাদের কতগুলি খাদ্য বা পানীয় আছে যেগুলির স্বাদ একেবারেই মুখোরোচক নয় তবু স্বাদ তার সঙ্গে আপস করে নেয় এবং অম্লান বদনে সেগুলি খাই বা পান করি। উদাহরণস্বরূপ, তামাক, মদ, সিগারেট, বিড়ি এগুলি মোটেই মুখোরোচক নয়, তবু নেশার কারনে আমরা খাই বা পান করি। আমাদের স্বাদবোধ এর প্রতি কোনো বিরোধ প্রকট করে না। নেহাত বেশী খেয়ে নিলে তা বমি করে অবশ্য বিরোধ করে। শত্রুতার চতুর্থ ধরনটি হল — কোনো অসুস্থতার কারণে যদি কোনো খাদ্যবস্তু খাওয়া নিষেধ থাকে, আমাদের স্বাদবোধ নিয়ত সেই খাদ্যবস্তুটির দিকে প্রলোভিত করে। মিষ্টি খাওয়া ডাক্তারের বারণ তবু সেই মিষ্টিটাই খেতে বেশী ইচ্ছে করে। লবন খাওয়া বারণ তবু নোনতা খাবারই খেতে বেশী ইচ্ছে করে। অতএব স্বাদের শত্রুতা থেকে সাবধান। সংসারে যত লোক না খেয়ে মরে তারচেয়ে অনেক বেশী খেয়ে মরে।
এবার মনের জগতে আসা যাক। কিভাবে মন আমাদের দূষিত হয়। দূষণমুক্ত মন না হলে মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায় না। প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার আগে একটি কথা মনে পড়ল। এক প্রাতঃভ্রমনের সঙ্গীকে বলেছিলাম,জানেন কিছু লোক আছেন যাঁরা কুকুর খুব ভালোবাসেন (Dog lovers), কুকুর নিয়ে প্রাতঃভ্রমনে যান। কেউ কেউ আবার বেড়াল ভালোবাসেন। গোপ্রেমীও অনেকে আছেন। আমি কিন্তু মানবপ্রেমী। মানুষের সান্নিধ্য আমায় খুব আনন্দ দেয়। তবে মানবপ্রেমে একটি বড়ো ঝুঁকি আছে। কুকুর পাগল না হয়ে গেলে সে তার প্রিয়জনকে কখনও কামড়ায় না; কিন্তু মানুষের বেলা সেরকম কোনো স্থিরতা বা guaranty নেই। কারণ মানুষের মধ্যে যে অপগুনগুলি আছে, যেমন লোভ, ঈর্ষা, অহমিকা ইত্যাদিগুলি কুকুরের মধ্যে নেই। তাই বলছিলাম, এই অপগুনগুলির কারণে বা অকারণে (আপাতদৃষ্টিতে) মানুষ মানুষকে কামড়ায়।
এবার সেই আগের প্রসঙ্গে আসা যাক। মনের এই দূষণ থেকে কিভাবে মানুষ নিজেকে সম্পূর্ন না হোক অন্ততঃ আংশিকরূপে মুক্ত হতে পারে ।
এ বিষয়টি নিয়ে অনেক ভেবেছি এবং মন দূষন সমস্যার সমাধানের কোথাও যেন একটি ইঙ্গিত আমি পেয়েছি ।
পাঠকের সাথে সেটি share করার বাসনায় এখানে লিখে রাখলাম।
পরিভাষায় একটা কথা প্রচলিত আছে “habit becomes a second nature”. কোনো কিছুর অভ্যাস করতে করতে সেটি আমাদের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। যেমন প্রায়ই বা প্রতিদিন নিঃস্বার্থ ভাবনা নিয়ে অপরকে সাহায্য করার যদি একটি অভ্যাস আয়ত্ত্ব করি (সাহায্য শুধু আর্থিক নয়) যে অভ্যাসটি ক্রমে ক্রমে একটি স্বভাবে পরিবর্তন হবার প্রবণতা দেখা দেবে। আর এই পরিবর্তনের মধ্যেই স্বভাবে আমাদের ত্যাগের ভাবনাটি আসবে আর ত্যাগের ভাবনার সাথে সাথে মনের লোভ বস্তুটিও ক্রমে ক্রমে বিলুপ্ত হবে। কারণ ত্যাগ ও লোভ একসঙ্গে থাকতে পারে না। এরা কার্যত antagonistic. একে অপরের সম্পূর্ণ বিরোধী। ঠিক সেইভাবে যদি আমরা একে অন্যের প্রতি সংবেদনশীলতা অভ্যাস করি এবং অভ্যাসটি যদি স্বভাবে পরিণত করি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা আমাদের নিজেদের কোনো কারণে দুখী নই, অন্যের বৈভব বা সম্পন্নতা দেখে দুখী হয়ে পড়ি। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার এইটি একটি অপগুন। Neighbour’s envy, owner’s pride এই মন্ত্রে বাজার আমাদের সকলকে সারাক্ষন দীক্ষিত করে চলেছে, যা সমাজের জন্যে হানিকারক।
এবার আমাদের অহমিকার বিষয়ে আলোচনায় আসি। সমাজে আমরা সবাই নিজেকে একটু প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, এই চাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ স্বাভাবিক চাহিদাটি যখন তীব্র হয়ে ওঠে তখন নিজেকে জাহির করার একটি উদগ্র বাসনা আমাদের মনে চেপে বসে, তখন আমি বা আমরা যা নই তারচেয়েও নিজেকে অনেক বড়ো বা মহান ব্যক্তি বলে সমাজের কাছে প্রস্তুত করার বাসনায় বশীভূত হয়ে পড়ি। সেই কারনেই সমাজে সত্যি মিথ্যের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়ে পড়ি। এক্ষেত্রে একটি অভ্যাস আমরা যদি আন্তরিকভাবে অনুশীলন করি, যেমন আমাদের কথায় ও কাজে যেন কোনো পার্থক্য না থাকে, কথায় ও কাজে যত বেশী ব্যবধান বাড়বে ততবেশী প্রথমে নিজেকেই প্রতারনা করব, পরে নিজের পরিবারকে, শেষে সমাজকেও প্রতারনা করবো। কথায় ও কাজের এই ব্যবধানটি যত কমাতে পারব, আমাদের অহংবোধটিও সেইভাবে হ্রাস পাবে।
উপরোক্ত অভ্যাসগুলি পালন করা নিশ্চয় কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। যেমন গায়ক হতে গেলে তো গানের অভ্যাস করতেই হবে। খেলোয়াড় হতে গেলেও খেলার মাঠে গিয়ে অভ্যাস করতে হবে, সেইভাবই মনের দূষণ অপসারনের জন্য আমাদের ঐ অভ্যাসগুলি আয়ত্ত করতেই হবে। এর জন্য আর অন্য কোনো উপায় আছে কিনা তা আমার জানা নেই। সহৃদয় পাঠকের জানা থাকলে জানাবেন। আমি কান পেতে রইলাম।
সংসারে এমন অনেক মানুষজন আছেন, যাঁরা সমাজের অনেক ভালো ভালো কাজে ব্যাপৃত থাকেন। সমাজের জন্য তাঁরা অনেক কিছু করেন, কিন্তু তাঁরা সমাজ থেকে অনেক প্রশংসা ও প্রচারও আশা করেন। এবং সেইকারণে তাঁদের ভালো কাজ করার আনন্দটি অন্যের প্রশংসার মুখাপেক্ষি হয়ে দাঁড়ায়। ভালো কাজ করার মধ্যে তখন আর সেই প্রাণের আবেগ থাকে না। প্রাণের আবেগ তখনি থাকবে যখন তার মধ্যে একটি আন্তরিকতা ও ভালোবাসার যোগসূত্র দেখা দেবে।
প্রশংসা এবং ভালোবাসা দুটোই আমরা একে অন্যের কাছ থেকে পেয়ে থাকি। তবে প্রসংশা পাওয়াটি অপেক্ষাকৃত সহজ। প্রসংশা পাওয়ার জন্য একে অন্যকে যখন বিশেষ গুন প্রদর্শন করে চমৎকৃত করি। ভালো ভালো কথা শুনিয়ে, ভালো গান শুনিয়ে, অভিনয় দেখিয়ে ভুরি ভুরি প্রসংশা আমরা পেতেই পারি। কিন্তু প্রশংসা আমাদের কানের পর্দা পর্যন্ত পৌঁছয়, সে জায়গায় ভালোবাসা হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশের ক্ষমতা রাখে। তবে ভালোবাসা পেতে গেলে অন্যকে ভালোবাসতে হবে। তাই ভালোবাসা two way traffic, প্রশংসার মতো one way traffic নয়।
কবিগুরু বলে গেছেন, “শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে”। কথার শেষ সত্যি নেই তাই শেষ কথা বলার কেউ নেই। কোটি কোটি কথার মধ্যে কোটি কোটি ভাবনার উৎপত্তি এবং সেই বিভিন্ন ভাবনার মধ্যেই বিভিন্ন জ্ঞানের আনাগোনা। রাশি রাশি না বলা কথার মধ্যে কালের আবর্তে কত ভাবনাই না এ সংসারে হারিয়ে গেছে। তবু জ্ঞানের শেষ নেই, কথারও শেষ নেই। কিন্তু আমার তো শেষ আছে। শেষ নিঃশ্বাসের সাথে সাথে আমি তো নীরব হয়ে যাবো। যতদিন আছি, আমার কথা আমি লিখে যাবো। এ আমার অনড় অঙ্গীকার।
***************