Monday, September 2, 2024

বিশ্বাস বনাম আত্মবিশ্বাস

 

অমরনাথ মুখার্জী

 

বিশ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস একপ্রকারের মানসিক স্থিতি, যার প্রভাব মানুষকে কিছু করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে; সেই কারণে এই দুটিকে আলাদা করে বিচার বিশ্লেষন করার প্রয়োজনবোধে এই নিবন্ধের অবতারনা।

বিশ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অত্যন্ত আবশ্যিক মনের দশা। যাকে বর্জন করে জীবনে অগ্রসর হওয়াই যায় না ; আবার এই বিশ্বাসই আমাদের যুক্তি বিচারকে আচ্ছন্ন করে, এক অন্ধগলিতে নিয়ে যাবার হাতছানি দেয়।তাই শেষ বিচারে বলবো বিশ্বাস আমাদের বাধ্যতা (compulsion) এবং সেইসঙ্গে বাধা (constraint) উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, এই যে আমরা দূরদূরান্তে রেলে অথবা বিমানে যাত্রা করি তখন বিশ্বাস নিয়ে আমাদের গাড়িতে বা বিমানে চড়তেই হয় যে এই চালক আমাকে নির্বিঘ্নে আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবে, চালকের পারদর্শিতা সম্পর্কে আমার না জানা থাকলেও; যেহেতু আমাকে বিশ্বাস নিয়ে চলতেই হবে , এটিকে তাই বলবো আমার বাধ্যতা আবার যদি জীবনযুদ্ধে অন্যের উপর বিশ্বাস করে (এমনকি ভগবানের উপরেও) নিরন্তর এগিয়ে চলি তাহলে আমার জীবনযুদ্ধের হাতিয়ারগুলি প্রয়োগের অভাবে নষ্ট হতে বাধ্য জীবনযুদ্ধের হাতিয়ারগুলি আমার হাত , পা আর বিচারবুদ্ধি ; এবং এই জীবনযুদ্ধের চেহারাটি কেমন ? সংসারে সবকিছুই তো অনিশ্চিত, এক মৃত্যু আর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলি ছাড়া। সেই কারণে আমাদের প্রতিনিয়ত প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে যেমন শারিরীক, মানসিক, পারিবারিক, সামাজিক এবং আর্থিক প্রতিকূলতা, যেটিকে আমরা আমাদের উপরোক্ত হাতিয়ারগুলির সাহায্যে অনুকূল করে দিচ্ছি। এটিকে আরেক ভাবে বলা যায় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম (Struggle for existence).

সাধারণত আমাদের মনের জগতটি দুটিভাগে বিভক্ত। একটি এর কাল্পনিক সত্যের জগৎ, অপরটি প্রমানিত সত্যের জগৎ। কাল্পনিক সত্যের জগতে যাঁরা অবস্থান করেন তাঁদের একমাত্র অবলম্বন ভবিতব্য ভগবান আর যাঁদের প্রমানিত সত্যের জগতে অবস্থান, তাঁরা প্রয়োগ এবং প্রশ্ন নিয়ে এগিয়ে চলেন এই কাল্পনিক সত্যের জগতটি কেমন? যেমন কিছু ব্যক্তি বলেন বা বিশ্বাস করেন, বীর হনুমান বা অশ্বত্থামা এঁরা নাকি আজও জীবিত, এঁরা অমর অন্যদিকে প্রমানিত সত্যের জগতের লোকেরা যেমন মানেন, জন্মালে তার মৃত্যু নিশ্চিত। আবার যে মৃত সে কখনই চিতাভস্ম বা কবর থেকে উঠে আসবে না (Resurrection), মানুষের রক্তের রং লাল, তা কখনও হলদে বা সবুজ হবে না। এখন যে যত বেশি কাল্পনিক সত্যের মধ্যে অবস্থান করেন বেশি কথাটা এইজন্যে বলা যে, বেশি কাল্পনিক সত্য জগতের  মানুষ হলেও পরিস্থিতি বা পরিবেশের তাড়নায় তাদের মাঝে মাঝে বাধ্য করে প্রমান প্রয়োগের শরনার্থী হতে এবং তাতেই তাঁদের আত্মবিশ্বাস ক্ষীন হয়ে যায়। দুর্বল আত্মবিশ্বাস নিয়ে জীবনযুদ্ধে মহড়া নেওয়া আর কিছুতেই সম্ভব হয় না আত্মবিশ্বাসের উৎস কোথায় ? দৃঢ় সংকল্পের মধ্যেই উঠে আসে আত্মবিশ্বাস আবার দৃঢ় সংকল্প তখনই নেওয়া যায় যখন আমাদের মনে ইচ্ছাশক্তির প্রচুর্য থাকে এই ইচ্ছাশক্তি কোন ঠিকানায় পাওয়া যায় সেটি প্রথমেই আমাদের নির্ধারন করতে হবে। ইচ্ছাশক্তির বসবাস প্রেরণা পরিবেশের মধ্যে যেমন কেউ যদি খেলায় পারদর্শী হতে চায়, তাকে খেলার মাঠে যেতেই হবে (পরিবেশ), যে খেলা শেখাবে তার সংস্পর্শে আসতেই হবে (প্রেরণা) সেইমতো যে গায়ক হতে চায় তাকে গানের রেওয়াজ যেখানে চলছে সেখানে যেতে হবে, আর যিনি গান শেখাচ্ছেন তার সংস্পর্শে আসতে হবে প্রেরিত হবার জন্য। শেষবিচারে, ইচ্ছাশক্তি প্রাপ্তি এবং বৃদ্ধির জন্যে পরিবেশ প্রেরনা এই দুটি নিতান্তই অপরিহার্য।

এরই সন্দর্ভে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। আমরা ১০/১৫ জন মিলে সকালে একটি গাছপালায় ঘেরা মাঠে ব্যায়াম করতে যাই সেখানে একটি যুবক অতি উৎসাহ নিয়ে / মাস আমাদের সঙ্গে ব্যায়াম করতে আসত। হঠাৎ দেখা গেল সে আর আসছে না। খবর নিয়ে জানলাম ইদানিং সে অন্যত্র কোথাও ঘুরতে যায় অকস্মাৎ একদিন ছেলেটির সঙ্গে রাস্তায় দেখা হওয়াতে জানতে চাইলাম আমাদের ওখানে না আসার কারণটি কি? জবাবে বলল ওকে কি আমাদের ওখানেই গিয়ে ব্যায়াম করতে হবে, অন্য কোথাও কি যেতে পারে না ? ওর প্রশ্নের উত্তরে ওকে আরেকটি প্রশ্ন করলাম তুমি কি মন্দিরে যাও ?

হ্যাঁ, আমি মন্দিরে যাই।

আবার প্রশ্ন করলাম, মন্দিরে কেন যাও ? ঈশ্বর তো সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বর দর্শনে মন্দিরে যেতে হয় কেন ?

ছেলেটির উত্তর না পেয়ে বললাম, তোমার জবাবটি আমিই দিচ্ছি তুমি মন্দিরে এইজন্যে যাও কারণ ওখানে একটি ধার্মিক পরিবেশ আছে এবং সৎসঙ্গ পাবার অবকাশও আছে ঠিক সেইভাবেই, আমাদের ব্যায়ামচর্চার স্থানটিতে আমরা সকলে মিলে একটি ব্যায়াম চর্চার পরিবেশ তৈরী করেছি নিঃস্বার্থ ভাবনা নিয়ে। ভবিষ্যতে তোমাকে প্রেরণা দেবার মতো হয়ত তুমি আর কাউকে পাবে না। বলাবাহুল্য, যুবকটিকে এরপর কোথাও দেখা যায়নি।

আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারে আরও একটু বলবার আছে সাধারণত আমরা আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার কাছে বশীভূত হয়ে থাকি, আর এই বশ্যতা আমাদের আত্মবিশ্বাসের বুনিয়াদকে ক্ষতিগ্রস্থ করে উদাহরনস্বরূপ যেমন সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর আমাদের বিবেক বা সাধারণ জ্ঞান মনে করায় কিছু স্বাস্থ্যচর্চা করতে তখন অনিচ্ছা আমাদের এমনভাবে বাধা দেয় বা demotivate করে যার জন্য বিবেক বা সাধারণ জ্ঞান কোনটাই তখন আর সক্রিয় করতে পারে না এবং সেই অনিচ্ছার কাছে হার মানার গ্লানিটুকু আড়াল দিতে নানান অজুহাতের চাদর দিয়ে ঢেকে আমরা সন্তুষ্টি পাবার চেষ্টা করি ঠিক এইভাবেই যারা মদিরা পানে আসক্ত বা ধূম্রপান বা তামাকে আসক্ত তাদের ইচ্ছাটি নেশার কারণে এতই তীব্র যে সবরকম ক্ষতি মানে, শারিরীক, পারিবারিক সেসব জানা সত্ত্বেও তীব্র ইচ্ছার কাছে নতজানু হয়ে নিজের আত্মগ্লানিকে নানান অজুহাতের চাদরে ঢেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায়। তাদের তখন ভবিতব্য আর ভগবান ছাড়া আর কোনো গতি থাকে না। আত্মবিশ্বাস তখন জীবনের তলানিতে গিয়ে ঠেকে। সম্প্রতি কাল্পনিক সত্য জগতের এক শিক্ষিত মানুষের সাথে দেখা হল। সাধারণ হালহকিকত জানার জন্য ওঁনাকে প্রশ্ন করাতে উনি জানালেন, এই শরীরস্বাস্থ্যই বলুন আর দশাদুর্দশাই বলুন এমনকি মৃত্যুও  আমাদের শতকরা ৮০% ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। এর থেকে কারোর কোনো মুক্তি বা রেহাই নেই। মানুষ প্রয়াস করে শুধু ২০% সামলাতে পারে ইচ্ছে করছিল বলি, যদি এই মানসিকতা নিয়ে ১০/২০ বছর আরও যদি আপনি সংসারে টিকে থাকেন  তখন দেখবেন আজকের এই পারসেন্টেজটি তখন ৯০% ভাগ্য এবং ১০% প্রয়াস বা আরো কম সংখ্যায় পাল্টে যাবে। কিছুই বললাম না কারণ ওরা কাল্পনিক সত্য জগতের মানুষ, যুক্তিতর্কের ধার ধারে না।

এবার ঠিক যে বক্তব্য নিয়ে আরম্ভ করেছি, সেইখানে ফিরে আসি।

বিশ্বাস আমাদের পরনির্ভরতা বাড়ায়। প্রশ্ন করার সাহস কেড়ে নেয়। প্রয়োগের কোনো ইচ্ছাই মনে জাগে না। বিশ্বাসে মিলায় বস্তুর নেশায় বুঁদ হয়ে নিজের অস্তিত্বের, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের চরম অবমাননা আমরা করি। অপরদিকে আত্মবিশ্বাস, জ্ঞানের আলোকে আমাদের চিন্তাচেতনাকে আপ্লুত করে। ক্রমান্বয়ে মনে প্রশ্ন জাগায় আর সে উত্তরের অন্বেষণে নব নব ভাবনা জাগে মনে।

    মহাকালের এই বিশাল অঙ্গনে মানবজাতির এই দীর্ঘ প্রাণের মিছিলে, আমাদের আত্মবিশ্বাস ভরা ক্ষণিকের এই উপস্থিতি কোথাও না কোথাও সামান্য একটু চিহ্ন রেখে যাবে, হয়তোবা তাও মিলিয়ে যাবে যুগান্তরের ঝরা পাতায়।

                     

                             *******

 

 

 

No comments: